২০০৮ সাল, অ্যাপলিকেশন করলাম সুইডেন এ। কোন বিশ্ববিদ্যালয় ভালো বা মন্দ এসব বাচ-বিচার না করেই Skövde তে এক বন্ধু/সহপাঠী ২০০৭ এ চলে গিয়েছিলো সেখানে ভর্তির জন্য দরখাস্ত করলাম। চান্স পেয়ে গেলাম, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে সুইডেনে চেল আসলাম, ১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ সালে। আমি দেখতে ইয়ং ছেলেদের মতই ছিলাম। ইত্তেহাদ এয়ারওয়েজ এর এক বিমানে রওনা দিলাম আর এক ছোটো ভাইয়ের সাথে (সে এক বছর জুনিয়র)। বিমান বন্দরে নেমে যখন সুইডেনগামী বিমানে উঠতে গেলাম কাউকে আটকালোনা আমারে দাড় করালো ভর্তির পেপারসগুলো সে দেখতে চাইলো। আমার ভর্তির কাগজগুলো ছিলো মেইন লাগেইজ এর সাথে হ্যান্ডব্যাগে নিতে ভূলে গিয়েছিলাম। যাই হোক অবশেষে রক্ষা হলো। সুইডেনে নেমেই দেখি ইয়া বড় বড় সব সিকিউরিটি গার্ড দাড়িয়ে আছে। এখানেও আমারে আটকায় জিগ্গেস করা শুরু করলো। তুমি কি করতে এসেছো?? ব্যবসা?? আমি বললাম যে পড়ার জন্য এসেছি। যা হোক সব কাজ শেষ করে রওনা দিলাম বন্ধু মামুনের বাসায়। সে একটু ফাস্ট। দু-টিনটি বড় বর ব্যাগ নিয়ে সে দৌড়াইতে বললো, বললো সুইডেনে সবাই নাকি দৌড়ের উপর থাকে। নতুন অভিগ্গতা হলো। একদিন তার বাসায় থেকে রওনা দিলাম Skövde এর দিকে। ওখানে গিয়ে ভালৈ লাগলো কিছুদিন পর আর বাকি বন্ধুরা চলে আসলো। একটি ব্যাপার উল্লেখ করা জরূরী যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমরাই প্রথম যারা একসাথে ৮ জন একই ডিপার্টমেন্ট থেকে পড়ার উদ্দেশ্য বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলো। সুইডেনে এ এসেই কিভাবে টাকা সেইভ করে চলা যায় সবার মাথায় একই চিন্তা শুরু হলো, কাজের সন্ধান ও শুরু হয়ে গেলো। শেষমেশ একটি পেপার জব মানে নিউজপেপার ডিস্ট্রিবিউটরের জব পেয়ে গেলাম, দুজন মিলে করতাম। সবাই মিলে একসাথে থাকায় সময় গুলো দ্রুত কেটে গেলো। আমরা বায়োমেডিসিন প্রোগ্রামে এসেছিলাম। থিওরী শেষ করে থিসিস করার উদ্দেশ্য রাজধানী শহর (স্টকহোল্ম) এ রওনা দিলাম। এসে এক বাসায় ৬ জন বন্ধু একসাথে উঠলাম। জবের জন্য ছুটাছুটি করা, থিসিসের জন্য লিখালেখি আর সপ্তাহান্তে বাসায় বাংলা পার্টির আয়োজন করে সময়গুলো কাটছিলো। দু-এক বন্ধু চলার মত জব পেয়ে গেলো। আমি পেপার বিলি করে থিসিসের জন্য লিখালেখি করতে করতে থিসিস পেয়ে গেলাম। থিসিস শেষ করতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হলাম। এক বাংলা গ্রোসারী দোকানে পার্ট টাইম জব করতাম আর থিসিস করতাম এভাবে একদিন থিসিস শেষ হয়ে গেলো। এরপর শুরু হলো আসল সমস্যা। জীবনের কিছু কঠিন সময়। কি করব?? কোন ওড জব করবো, পিএইচডি পজিশনের জন্য অপেক্ষা করব নাকি দেশে ব্যাক করে বিসিএস ট্রাই করবো। কারন বিসিএসের চিন্তা সব সময় মাথায় কাজ করত। কিছু বন্ধু জবও পেয়ে গেলো। মানুষকে অনুরোধ করা বা মানুষের পেছনে জবের জন্য তেল দেয়া আমার অভ্যসে ছিলোনা। এখানেও জীবনের কিছু বাস্তব অভিগ্গতার সম্মুখীন হলাম। এক বন্ধু মুটামুটি ভালো বেতনের জব পেয়ে গিয়ে একটা পজিশন তৈরী করে নিলো। তাকে জবের জন্য বলেও জব পাচ্ছিলাম না। যদিও সে আমার বন্ধু ছিলো সে অবশ্য অনেক মানুষকে জব দিয়েছিলো। কিন্তু আমার ব্যাপারে কেনো জানি একটু অন্যরকম ছিলো হয়ত ইসলামী সংগঠন করতাম তাই। অবশেষে আর এক বন্ধুর অনুরোধে সে ৩ ঘন্টার একটি কাজ দিলো। ৩ মাস কাজ করলাম করার পর আমার কাজ আরো বেশি পাওয়ার কথা এবং আমার নিজের নামে কাজ হওয়ার কথা। বন্ধু টি অন্য ছেলেদের কাজে সহায়তা করলো আমাকে বললো তুই অন্য জব দেখ, সে একথাও বললো তোর সুইডেনে আসাই ঠিক হয়নি দেশে থাকলে ই পারতি।
আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে পরিকল্পনা পরিবর্তন করলাম। উপশালা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলাম এ্যাপ্লাইড বায়োটেকনোলগিতে, পাশাপাশি দীপন ভাইয়ের সহায়তায় একটি রাতের পেপার ডিস্ট্রিবিউটরের জব পেয়ে গেলাম। পরিকল্পনা ছিলো বায়োটেক এ মাস্টার্স করবো পাশাপাশি পিএইচডির জন্য অ্যাপ্লিকেশন করবো আর বিসিএসের জন্য পড়ব। রাতের নিউজপেপার ডিস্ট্রিবিউটরের জব জীবনে চিন্তা করিনি আমি বাড়ির ছোট ছেলে ছিলাম। ছাত্রও খুব খারাপ ছিলাম না, যাই হোক আমি সব কিছু মেনে নিয়ে সামনে চলতে অভ্যস্ত ছিলাম এবং রিজিকের জন্য আল্লাহর উপর সব সময় নির্ভরশীল ছিলাম।
দু-রাত পেপার দিয়ে অনেক কষ্ট অনুভব করছিলাম। তৃতীয়দিন গেলাম না অসুস্থতার কথা বলে। ইতোমধ্যে আমার থিসিস সুপারভাইজরকে নিয়মিত মেইল করতাম পিএইচডি পজিশনের জন্য। অবশেষে হঠাত করে তার একটি মেইল পেলাম যে আমি যদি কমিটেড হই, এবং পিএইচডি করতে চাই তাহলে তাকে যেন জানাই। তাকে জানালাম যে আমি অবশ্যই পিএইচডি করতে চাই।
সে আমাকে একটি লিংক দিয়ে অ্যাপ্লাই করতে বললো। বললো যে তারা ড্রাগ স্ক্রিনিংয়ের কাজ করছে ৬ মাসের জন্য নিবে তারপর কাজ দেখে এক্সটেন্ড করবে। দরখাস্ত করলাম। এদিকে বায়োটেক এর ক্লাশ নিয়মিত শুরু করলাম। আমি থিসিস শেষ করেছিলাম জুলাই ২০১০।
জানয়ারী ২০১১ এ সুপারভাইজরের দেয়া লিংকে অ্যাপ্লাই করেছিলাম। হঠাত সুপারভাইজের মেইল যে তুমি কি দরখাস্ত করেছিলা?? বললাম যে জ্বি করেছিলাম, সে বললো তুমি আরো একটু স্মার্ট হতে পারতে তাদের ফোন দিতে পারতে। সে বললো ওরা নাকি একজনকে নিয়ে নিয়েছে। ভাবলাম রিজিক এ নেই আমি প্রচন্ড লাজুক আর আত্নসম্মানসম্পন্ন মানুষ। গায়ে পরে কাউকে অনুরোধ করার অভ্যস কোনদিনও ছিলো না।
আমি স্টকহোল্ম থেকে উপশালা যাতায়াত করতাম। স্টকহোল্মে রাতে পেপার জব দিতাম আর দিনের বেলা উপশালা গিয়ে ক্লাশ করছিলাম। ৩০ জানুয়ারী ২০১১ ক্লাশ শেষে উপশালা র ইকবাল ভাইয়ের রুমে গেলাম দেখা করতে ভাবলাম ই-মেইলটা চেক করি, ই-মেইল চেক করে দকেহি একটি মেসেজ যে আমি ভাইভা দিতে পারবো কিনা। রিপ্লাই দিলাম যে আমি আজেকই ভাইভা দিতে পারবো। পরের দিন ভাইভা দিয়ে তারপর দিন থেকে কাজ শুরু করলাম। এভাবে দু-বছর রেসার্স এ্যাসিসটেন্ট হিসেবে কাজ করলাম। এর মাঝে অনেকবার ইচ্ছে হচ্ছিলো বিসিএস দিয়ে আসি। শেষ যখন ২০১২ এর দিকে মুটামুটি শিউর হলাম যে পিএইচডি রেজিস্ট্রেশন হয়ে যাবে তখন ভাবলাম দু-নৌকায় পা না দেই। তখন সিন্ধান্ত নিলাম যে পিএইচডি টা আগে শেষ করি যেহেতু সুইডেনে এসেছিলাম ডিগ্রি নিতে ডিগ্রি নেই।
পিএইচডি রেজিস্ট্রেশনের আগে অবশ্য আমাকে জিগ্গেস করা হয়েছিলো যে আমি সুইডেনের পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট পারমিট নিতে চাই নাকি পিএইচডি নিতে চাই। চিন্তা করলাম যে যেহেতু পিএইচডি নিতে এসেছি এবং ডিগ্রি থাকলে পৃথিবীতা আরো ওপেন হয়ে যাবে, আবার সুইডেনে থেকে যদি ওড জব করা লাগে তাহলে থেকে লাভ কি। সুতরাং বলে দিলাম যে আমার ডিগ্রি চাই সুইডেনে পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট পারমিট পাই আর না পাই।
অবশেষে আল্লাহর অশেষ রহমতে পিএইচডি রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয় ২০১৩ এর জানুয়ারীর ৩০ তারিখ। পিএইচডির হাফ টাইম শেষ হয়েছে জুন ২০১৪।
পথ চলছি….. আল্লাহ যতদুর নিয়ে যায়।
সবার দোয়াপ্রার্থী…….