ছোট বেলায় যখন সাইমুম সিরিজের বই পড়তাম ঠিক তখন থেকে মনের মধ্যে স্পেন ভ্রমনের স্বপ্ন বাসা বাঁধে। গ্রানাডার আর্তনাদ কিংবা কর্ডোভার ছবি মনের মধ্যে ভেসে উঠত নিজের অজান্তে। কিন্তু সেই প্রত্যন্ত গ্রামের লালিত স্বপ্ন কখনও পূরণ হবে তা কখনই ভেবে দেখিনি। কিন্তু সৃষ্টি কর্তার কি অপার করুণা তার পরিকল্পনা বুঝার সামর্থ্য কারও নেই। যেদিন বাংলাদেশ থেকে সুইডেন এ পারি দিলাম সেদিনই হয়তো জীবনের অবচেতন মনের লালিত স্বপ্ন গুলোর পূরনের শুরুটা হয়ে গিয়েছিলো।
আর স্পেন ভ্রমনের প্রস্তাবটা আসলো হঠাৎ করেই। হঠাৎ আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় সাইফুল ভাইয়ের স্পেন ভ্রমনের প্রস্তাব সহ বার্তা। সেনাপতির ডাকে সৈনিকেরা যেমন যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠিক তেমনি সাইফুল ভাইয়ের মেইল মানে কিছু একটা ঘটতে যাওয়া, ব্যস সবাই রাজি হয়ে গেলো।তারিক বিন যিয়াদ কিংবা মুসা বিন নুসাইর এদের নাম শুনলেই মনটা চলে যায় কল্পানায়, কেমন ই বা ছিলেন উনারা যাদের স্পর্শে পৌত্তলিক স্পেন থেকে হয়েছিলো ইসলামিক স্পেন । আর এই স্পেনকে কেন্দ্র করে ইসলামের সুবাতাস ছড়িয়ে পড়েছিলো গোটা ইউরোপে।
দশজনের একটি দল নিয়ে আমরা বেরিয়েছিলাম স্পেন ভ্রমনে, মনে হচ্ছিলো স্পেন জয় করতে যাচ্ছি। যাত্রাপথের অপরূপ সৌন্দর্য্য সবাইকে বিমোহিত করে তুলেছিলো। রাস্তার দু-ধারে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সারি সারি জলপাই আর কমলা গাছের বাগান। জলপাই গাছগুলো দেখার সাথে সাথে কানে ভেসে উঠছিলো কুরআনের সেই জয়তুন শব্দটি। কি অপুর্ব এক অনুভূতি, মনেহচ্ছিলো হারানো কিছু ফিরে পেয়েছি কিংবা নিজেদের জায়গায় চলে এসেছি। শহরের ভিতর রাস্তার দু-ধার দিয়ে শুধু ই কমলার গাছ। মনেহয় আল্লাহ অশেষ দানে ভরিয়ে দিয়েছেন স্পেনকে। আমরা মূলত মুসলিমদের ঐতিহ্যবাহী কিছু জায়গা দেখার সুযোগ পেয়েছি। গ্রানাডা, কর্ডোভা, নাসরিড প্যালেস, আল কাজাব এসব জায়গায় গিয়ে যেমন কষ্ট পেয়েছি তেমনি তেমনি অভিভূত হয়েছি বিল্ডিং গুলোর সৌন্দর্য দেখে। কর্ডোভার বিশাল মসজিদ যা এখন ক্যাথেড্রাল এ পরিনত করা হয়েছে, সেটি দেখে আমরা কিছুক্ষন নিশ্চুপ হয়্ব যাই। তার সামনে কমলা গাছের বাগানে বসে জিড়িয়ে নেই কিছুক্ষন মসজিদে ঢোকার প্রস্তুতি আর কি। ঢুকতে হবে আবার টিকেট করে। যেই গেইটে গিয়েছি প্রশ্ন করা হলো মুসলিম কিনা? মুসলিম হলে ভিতরে সালাত আদায় করা যাবে না এমনকি মেঝেতে বসা ও যাবে না। সত্যিই তখন কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো, আমাদের মসজিদ আবার আমাদের কাছ থেকে চাদা নেয় আবার আমাদের ই বলে যে সালাত আদায় করা যাবে না, অথচ ভিতরে ঢুকে দেখি খ্রীষ্টান রা তাদের ধর্ম পালন করছে। ভিতরে ঢুকে সবাই অবাক সেই মিম্বার মেহরাব এখন ই অবিকল সেরকম ই আছে। না শুধু মুসলিমদের চেতনা বোধ। নাসরিদ প্রাসাদ ও আল কাজাব এর দেয়াল জুড়ে ততকালীন মুসলিমদের কারুকার্য আর আরবী হরফের ও কুরআনের আয়াতের ক্যালিওগ্রাফী সেদিনের মুসলিম সুদিনের কথাই মনে করে দেয়। এসব দেখে স্পেন এ মুসলিমদের পরাজয়ের কারন নিয়ে আমি একটু চিন্তায় মগ্ন হলাম। তেমনি চিন্তা হতে লাগলো ভারতে বর্ষে মুসলিমদের পরাজয়ের কারন নিয়ে। যেখানে মুসলিম দের ঈমান ও আখলাক দেখে আমাদের অভিভূত হওয়ার কথা সেখানে আজ আমরা মুসলিমদের কিছু ঐতিহ্য দেখে আত্নতুষ্টি লাভ করছি। অথচ মুসলিদের তৈরী করা জিনিস দেখিয়ে পয়সা কামাই করছে অন্যধর্মের লোকজন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুসলিমদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সব কিছু দেয়ার জন্য। আসলে উনি দিয়েছিলেন ও তাই আমরা রাখতে পারিনি। যখন মুসলিমদের আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোন রাজ্য দান করেন তখন মুসলিমরা দ্বীন ইসলামকে ছড়িয়ে না দিয়ে প্রাসাদের কারুকার্য তৈরী আর ভোগ বিলাসে মত্ত থাকতো।
ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে যখন ইসলাম বিজয় লাভ করতে লাগলো সবখানে তখন আল্লার অনুগ্রহ ও জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত বান্দারা দুনিয়া ও আখেরাত দুটি জিনিস পেয়েও ক্ষান্ত হয়ে বসে থাকেননি। ছুটে বেরিয়েছেন দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার কাজে। কেউ ইসলাম গ্রহন করলে নবী (সঃ) বলতেন দারিদ্রতাকে মেনে নেয়ার জন্য। অথচ আজকে ইসলামী সংগঠনের লোকদের দিকে তাকালে দেখা যায় উনারা টাকা দিয়ে সামাজিক প্রতিপত্তি দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চান। সম্পূর্ণ একটি উল্টো প্রটোকল দিয়ে কোন সফল পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। আগে ভোগ তারপর দ্বীন এরকম নীতি নিয়ে কখন ই মুসলিম রা বিজয়ী হয়নি, আর ইসলাম ও এভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। আগে সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠা তারমানে দুনিয়াদারী তারপর আখেরাত এর ব্যবস্থা এই নীতি নিয়ে কখন ই ইসলামী সংগঠনকে বিজয়ী করা সম্ভব না, আর বিজয়ী করা গেলেও ইসলাম কে তার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। আমি কখনি ই বলিনা যে সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করতে হবে না। অবশ্যই তা করতে হবে কিন্তু সাংগাঠনিক প্রয়োজন কিংবা ইসলামের প্রয়োজনের চেয়ে যখন সামাজিক প্রতিপত্ত অর্জন বেশি অগ্রাধিকার পায় তখনি কেবল একটি আশাংকা হয় যে মনের মধ্যে ভোগের ঘুমন্ত বাসনা আবার জেগে না উঠে। আর হয়ত উঠছে ও আর তাই অনেক টাকা ওয়ালা ক্ষমতা ওয়ালা ইসলামিক লিডার দেখা যায় কিন্তু সবকিছু আগের মত ই থেকে যায়। ভারত বর্ষে মুসলিমরা প্রায় ৬০০ বছর শাসন করার পরে ও ভারতে ইসলামের তেমন কোন কাজ ই করেনি, তেমন কিছু চোখে ই পড়েনা অথচ সেখানে স্পেনে খ্রীষ্টানরা পুরো চেহারাই পাল্টে দিয়েছে আর এটা করতে পেরেছে কারন তারা যা বিশ্বাস করে তাই তারা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে সেটা দুদিন পরে হলে ও, সেখানে আমরা এমন মুসলমান যে আমাদের বিশ্বাস টা কি, কেমন সেটাই ঠিক মত বুঝে উঠতে পারি না বা পারি নাই। আমরা বিশাল বিশাল প্রাসাদ নির্মান করেছিলাম, আমরা বিশাল বিশাল মসজিদ নির্মান করেছিলাম, কিন্তু আসল কাজটাই করা হয়নি। শরীর ও মনটাকে যে মুসলিম বানাতে হবে সেটাই করতে পারিনি। আর পারিনি বলে আমরা সেই দুষিত মন নিয়ে এই দুনিয়ায় ও আল্লাহর রহমত থেকে বিতাড়িত হয়েছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া কে জান্নাত থেকে বের করে দিয়ে আমাদের যে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন আমরা তা নিতে পারিনি। আল্লাহ আমাদের বার বার তার রহমতের ছায়ায় স্থান দিচ্ছেন কিন্তু আমরা উপলব্ধি করতে পারিনা যে সব ঘটনার মধ্যে একটি গভীর মিল বর্তমান আর তা হলো বান্দার প্রতি আল্লার ওয়াদা সেটা ভালো হোক আর শাস্তিমূলক ই হোক তা বান্দারা চাক্ষুস দেখতে পাবেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের বার বার শাসন ক্ষমতা দিয়ে তার আুনুগ্রহের পরিচয় দিয়েছেন , দিচ্ছেন। কিন্তু ভোগের চিন্তায় মসগুল আমরা বুঝতেই পারিনা যে আমাদের দায়িত্ব কোনটি। দেখে মনেহয় সবাই ইসলাম প্রতিষ্ঠায় মশগুল। সবাই জান প্রান ঢেলে দিচ্ছেন ইসলামের জন্য কিন্তু ফল পাওয়া যাচ্ছেনা কারন যে জন্য জান ও মাল ঢালা দরকার সেটার জন্য করা হচ্ছে না। আগে জান ও প্রান ঢালতে হবে একজন পূর্ণাংগ মুমিন হওয়ার জন্য। দ্বীনের কাজ করতে হবে আল্লাহকে সন্তুষ্টির জন্য। কিন্তু আমরা উল্টোটা করছি। দ্বীন প্রতিষ্ঠার আগে যোগ্য মানুষ তৈরী করতে হবে সংগঠনের বইয়ে পড়েছিলাম। আমার কাছে মনেহয় সেই যোগ্য মানুষগুলোর স্থান সাথী ও সদস্যরা কেনো জানি পূরণ করতে পারছে না। হয় এটা তদের ই অযোগ্যতা নতুবা সাথী ও সদস্য হওয়ার সিস্টেমের সমস্য এটা খুজে বের করা খুব ই প্রয়োজন তা না হলে কাংখিত সফলতা বা দ্বীন প্রতিষ্ঠা সম্ভব না, চীন মৈত্রী সম্মলন কেন্দ্রে সম্মেলন আয়োজন করতে হবে না হলে সন্মান যাবে, এসব মানসিকতা তৈরী হতনা। রাসুল (সাঃ) খেজুড় পাতার প্রাসাদে বসে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, উমর (রাঃ) এর মতো মানুষেরা রাতের বেলায় খাবার কাধে নিয়ে বেরিয়েছেন। অথচ আমরা মৌলিক প্রয়োজন বঞ্চিত মানুষের চিন্তা না করে আমরা সন্মানের চিন্তা করি। আমাদের বিশাল বিশাল বিল্ডিং দেখা যায় অথচ অনেক মানুষ রাস্তায় ঘুমায়, আমরা মিছিল করে ভুনা খিচুরী খাই অথচ অনেক মানুষ না খেয়ে থাকে। ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হলে আগে মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও ত্যাগ কে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নতুবা মিথ্যা আবেগ দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। ঢাকায় গিয়ে ঢাকা দখলের চিন্তা না করে আগে মানুষের হৃদয় দখলের চিন্তা করতে হবে তাহলে এমনিতেই ঢাকা দখল হবে। যারা শপথ নিয়েছিলেন দ্বীন হবে জীবনেদ্দশ্য তাদের সেই উদ্দেশ্য কি আজ ও বর্তমান আছে একটু চিন্তা করা দরকার। যেখানে নবী করীম (সাঃ) ও সাহাব (রাঃ) রা ইসলামের জন্য সম্পদ ত্যাগ করেছেন ত্যাগ করেছেন সামাজিক অবস্থান সেখানে আমরা এসব আকড়ে ধরে রাখছি আবার ইসলাম ও কায়েম করতে চাচ্ছি। আসলেই কি এভাবে সম্ভব ???
আমার কেনো জানি মনেহয় কোথাও একটি ভূল আছে, হয় আমাদের শিক্ষার মধ্যে না হয় আমাদের উপলব্ধির মধ্যে।
আমার মনে হয় আমাদের শিক্ষার মধ্যে ভুল আছে।
Ashole amader bujhar vul mone hoy….apnake onek thanks